• Breaking News

    বিশ্বকাপ আনন্দযজ্ঞে ৯ / সৃষ্টিশীলতাকে ল্যাং–লাথি! / কাশীনাথ ভট্টাচার্য

    [avatar user="kashibhatta" size="thumbnail" align="left" /]

    শিল্প–বিপ্লবের দেশে শ্রমিক–ফুটবলার শ্রেণীর পতাকা উড়ল পতপত করে, সৃজনশীলতাকে আক্ষরিক অর্থে ‘লাথি’ মেরে তাড়ানো হল বিশ্বকাপের আসর থেকে, আর, শেক্সপিয়ারের দেশে ফুটবলেও জন্ম নিল সেই চিরন্তন প্রশ্ন, ‘টু বি অর নট টু বি’ — বল গোললাইন পেরিয়ে ছিল, নাকি পেরয়নি!

    যেমন যান মাঝেমাঝেই, ইংল্যান্ডে আবারও গিয়েছিলেন কাইজার বেকেনবাওয়ার, ২০১৪ বিশ্বকাপের ঠিক আগে। প্রায় ৪৭ বছর পরও যেখানে গিয়েছেন, অনেক প্রশ্নের মধ্যে একটা সব জায়গায় ‘কমন’, ‘কী মনে করেন, জিওফ হার্স্টের শট কি বারে লেগে গোললাইনের ভেতরে পড়েছিল?’ ফুটবলের যুবরাজ জানিয়েছেন, ১৯৬৬–র পর যতবার এসেছেন, একই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বোধহয় কয়েক হাজার বার। তবু, তাঁর আশা, জীবদ্দশায় আরও যত বার যাবেন ইংল্যান্ডে, আরও কয়েক হাজার বারই বলতে হবে, ‘না, গোললাইন পেরয়নি বল!’

    উত্তর ইউরোপীয় ফুটবলের সেই জয়গাথা এখনও লিখে চলেছে ফুটবলের পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত ইংল্যান্ড। আর করবেই বা কী? হোক না কলঙ্কিত, বিশ্বকাপ তো!

    আর, বিশ্বকাপের অনেক দিন আগে, মার্চ মাসে, প্রথমবার চুরি হয়েছিল জুলে রিমে ট্রফি। রাখা ছিল ওয়েস্টমিনস্টারের স্ট্যাম্পেক্স প্রদর্শনীতে। খোঁজ খোঁজ রব স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে, সপ্তাহখানেক পর দক্ষিণ–পূর্ব লন্ডনের এক বাগানে মাটির তলায় সেই ট্রফি খুঁজে পায় ‘পিকলস’ নামের একটি কুকুর। বিশ্বকাপ ইতিহাসের সঙ্গে যার নাম এখন জড়িয়ে রয়েছে অঙ্গাঙ্গিভাবে। তবে, ১৯৭০ সালে ব্রাজিল তৃতীয়বার জুলে রিমে ট্রফি জিতে চিরতরে সেই ট্রফি নিজেদের দেশে নিয়ে যাওয়ার পর ১৯৮৩ সালে রিও থেকে ট্রফিটি চুরি গিয়েছে এবং আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। গোয়েন্দাদের ধারণা, ট্রফিটি গলিয়ে সোনা নিয়ে চম্পট দিয়েছে দুষ্কৃতীরা।

    প্রথম পর্ব

    পেলের নিজের কথায়, ‘আমাদের ডিরেক্টররা ভেবেছিলেন ভগবান আসলে ব্রাজিলীয়, ভুলে গিয়েছিলেন যে ভগবান তাদেরই সহায় হয় যারা নিজেদের কাজ ঠিকঠাক করে।’

    ব্রাজিল তাদের কাজ ঠিকঠাক করেনি, কোনও সন্দেহ ছিল না কারও। পরপর দুবার বিশ্বকাপ জেতার পর ভেবে নেওয়া হয়েছিল, কোনওরকমে যাবে আর বিশ্বকাপ জিতে নিয়ে আসবে। সে জন্য পুরনো কয়েকজন বিশ্বজয়ীদের দলে রাখা হয়েছিল, উঠে এসেছিলেন কয়েকজন আনকোরা নতুনও, তবে বয়স খুবই কম। ওই কোনওমতে দল গড়ে পাঠানো।

    শক্ত গ্রুপ তো বটেই। ইউসেবিও–র পর্তুগাল, হাঙ্গেরি, বুলগারিয়া। প্রথম ম্যাচেই বুলগারিয়া মারতে শুরু করল। পেলেকে মার্ক করার দায়িত্বে দোব্রোমির ঝেচেভ। এমনিতেই চোট নিয়ে খেলতে এসেছিলেন পেলে, এবারও। ঝেচেভের মারের পর, ‘পায়ে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। সারাক্ষণ শুধু মেরেই গেল পেছন থেকে। পায়ে, গোড়ালিতে।’ তখন রেফারির হাতে বলপ্লেয়ারদের আলাদা করে রক্ষার কোনও অস্ত্র ছিল না। বলপ্লেয়ারদের বাঁচানোর চেষ্টা শুরু হয়েছিল স্পেনে ১৯৮২ বিশ্বকাপে ক্লদিও জেন্তিলের হাতে একে–একে জিকো–মারাদোনা বারবার নির্যাতিত হওয়ার পর থেকেই। কিন্তু, পেলের আমলে সেই সবের ছিটেফোঁটাও নেই। ফুটবলের সবচেয়ে কদর্য দশক। ইউটিউবে এই ম্যাচগুলো পুরো দেখার সুযোগ আছে এখন। জায়েন্টস অফ ব্রাজিল–এ যা দেখা গিয়েছিল খানিকটা, ইউটিউব এখন ঘরের মধ্যেই হাতে তুলে দিয়েছে অস্ত্র, নিজের চক্ষু–কর্ণের বিবাদভঞ্জনে ইতিহাসের পাতায় বিদগ্ধ সমালোচকদের মন্তব্য পড়েও জ্ঞানী সাজার দরকার নেই। নিজে দেখেই বিচার করতে পারবেন যে, হলুদ কার্ড দেখেছিলেন ঝেচেভ, এখন হলে প্রথমার্ধেই লাল কার্ড দেখে বেরিয়ে যেতে হত।

    পেলে অবশ্য তাঁর কাজ ঠিকই করে গিয়েছিলেন। ১৩ মিনিটে ঝেচেভের ফাউল। মার খেয়ে ভেতরে ভেতরে তখনই বোধহয় এত রেগে গিয়েছিলেন, প্রভাব পড়েছিল ফ্রি–কিকে। সাধারণত ব্রাজিলীয়দের ফ্রি–কিক বলতেই যে বাঁক–খাওয়ানো শটের কথা মনে পড়ে তেমন নয়। এই ফ্রি–কিক অসম্ভব জোরালো, মানব–প্রাচীর ভেদ করে যেন গোলরক্ষককে ইয়র্ক করেছিল, লিখেছেন ক্রিস ফ্রেডি। দ্বিতীয় গোল গারিনচার ফ্রি–কিক থেকে। পেলেকে পরের ম্যাচে বিশ্রাম দেওয়া হবে, ঘোষণা করে দিয়েছিলেন কোচ ফিওলা।

    সিদ্ধান্তে ভুল, অবশ্যই। হাঙ্গেরি তখনও বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা শক্তি। আর, ১৯৫৪–তে শেষবার বিশ্বকাপে যাদের কাছে হেরেছিল ব্রাজিল, ১৩ ম্যাচ পর হার আবার তাদের কাছেই। ১–৩, ব্রাজিলের একমাত্র গোল আবার ফ্রি–কিক থেকে, ১৯ বছর বয়সী তোস্তাও পা ছুঁইয়ে সমতা ফিরিয়েছিলেন। গারিনচাকেও ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল এই ম্যাচ থেকে, সেপেসির জোরালো ট্যাকলের ফল। ব্রাজিলের হয়ে ৫০–তম ম্যাচে হেরে বিদায়, আর কখনও ব্রাজিলের জার্সি পরেননি গারিনচা।

    পরের ম্যাচে ইউসেবিও–র পর্তুগাল। পেলে ফিরলেও কিছু করার ছিল না। হেরে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ব্রাজিল এই ম্যাচে ৯ জন ফুটবলার বদল করেছিল। ইউসেবিওকে মার্কিং–এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বাচ্চা ছেলে অরলানদোকে। পেলের কথায়, ‘It would have been ridiculous in a junior league. In the World Cup, against one of the strongest teams of the tournament, it was suicidal.’ আহত পেলে যাতে আহত থেকেই বিশ্বকাপের বাইরে যান, চেষ্টার কোনও কসুর রাখেননি পর্তুগিজ ডিফেন্ডাররা। ম্যাচের শুরুতেই কড়া ট্যাকল, কেটে গেল হাঁটু, কার্ড কেন? মোরেস কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিলেন জোড়া পায়ে জোড়া ফাউলে। দলের চিকিৎসক এবং ম্যাসিওরের কাঁধে ভর দিয়ে পেলের বেরিয়ে যাওয়া মাঠের বাইরে, ১৯৬৬ বিশ্বকাপের ‘সেরা’ বিজ্ঞাপন। বুঝিয়ে দেওয়া, বল পায়ে নিয়ে খেলার চেষ্টা করলে এভাবেই বের করে দেওয়া হবে, এটা ইউরোপ!

    কিন্তু, বিপদ এসেছিল অন্য দিক থেকে। আফ্রিকা অন্ধকারাচ্ছন্ন, এশিয়া তো নয়। চেয়েছিল নিজেদের অঞ্চলে বাছাইপর্বের খেলা খেলতে। ফিফা অনুমতি দেয়নি। ফলে গোটা আফ্রিকা বয়কট করেছিল বিশ্বকাপ। সঙ্গে এশিয়ার বড় বড় দেশও। উত্তর কোরিয়া গিয়েছিল বিশ্বকাপে, অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ৯–২! এবং বিশ্বকাপের জন্য ঘেরা জায়গায় দীর্ঘদিন অনুশীলন করে। উত্তর ইউরোপকে পাগল করে দিয়েছিল তাদেরই অস্ত্রে, শুধু দৌড়ে। কী অসম্ভব গতি, যাঁরা খেলেছিলেন, জানেন। রুশদের সঙ্গে পারেনি, বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ। চিলের সঙ্গে ড্র করে যেন আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল। তাই পরের ম্যাচে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ অঘটন!

    দুবারের বিশ্বসেরা ইতালির হার উত্তর কোরিয়ার কাছে, মিডলসবোরোর ১৭ হাজার ৮২৯ জন দর্শক নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ৪২ মিনিটে গোল খেয়ে ইতালি সেই গোল শোধ দিতে পারেনি, বিশ্বকাপে সদ্য খেলতে আসা দলের বিরুদ্ধে, তা–ও আবার সেই দলের কোনও ফুটবল ইতিহাস নেই, এশিয়ার আনকোরা দল — ভাবা যায়? শেষ ঘণ্টা দশজনে খেলেছিল, ইতালির মতো দলের কাছে কোনও অজুহাত হতে পারে না। আসলে ভুল তো গোড়ায়। সহকারি কোচ ফেরুচিও ভালকারেজি তো কোরীয়দের প্রথম দিনের খেলা দেখে এসে বলেই দিয়েছিলেন, কোনও ব্যাপার নয়, কোরীয়রা হাসির খোরাক হতেই এসেছে। আত্মবিশ্বাস যখন আত্মতুষ্টি, অঘটন নিশ্চিত।

    কোয়ার্টার ফাইনাল

    একা পেলে নন, দক্ষিণ আমেরিকার সব দেশের বিরুদ্ধে এক কাজ। হয় জার্মান না হয় ইংরেজ রেফারি থাকবেন, নিশ্চিত করা হয়েছিল। পেলে ছাড়াও প্রচুর এমন লোক আছেন যাঁরা জানতেন ফিফা সভাপতি ইংরেজ স্যর স্ট্যানলি রাউসের সেই নির্দেশের কথা। রেফারিদের পরিষ্কার করেই বলে দেওয়া হয়েছিল, ইউরোপীয় ধাঁচের ফাউলের ক্ষেত্রে ‘সমঝে চলুন।’ পর্তুগাল–ব্রাজিল ম্যাচ নিয়ে ইংরেজ ব্রায়ান গ্ল্যানভিলও লিখেছিলেন, ‘The game was in Portugal's pockets, and there was no excuse, not even that of cynical necessity, for Morais to chop down Pele... The indulgent, flaccid English referee, George McCabe, allowed Morais to stay on the field, so that now Portugal were virtually playing against ten men.’ মনে রাখুন, এই গ্ল্যানভিলের কাছেই কিন্তু ইংল্যান্ডের এই বিশ্বজয় ছিল ব্রাজিলের — এমনকি সত্তরের বিশ্বজয়ের একপেশে ও একঘেয়ে দাপটের চেয়েও — তুলনায় অনেক এগিয়ে। আর, লাতিন আমেরিকার ওপর নিশ্চিতভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইউরোপের প্রাধান্য, ওই ১৯৬৬ বিশ্বকাপে। তাঁর কলমেই আবার ইংরেজ রেফারি ছিলেন ‘flaccid’ অর্থাৎ দুর্বল বা শিথিল; ‘indulgent’ অর্থাৎ প্রশ্রয়দানকারী!

    ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আর্জেন্তিনার খেলায় জার্মান রেফারি রুডলফ ক্রিয়েটলিন আর্জেন্তিনীয় অধিনায়ক রাতিনকে বের করে দিলেন, রেফারির সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করায়! ফাউলটাও রাতিনের ছিল না, অধিনায়ক হিসেব ক্রমশ হতে–থাকা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার নৈতিক দায়িত্ব পালন করছিলেন রাতিন। যেহেতু, ম্যাচের শুরু থেকেই রেফারিও তাঁর নৈতিক দায়িত্ব পালন করে আয়োজক দেশকেই দেখছিলেন, রাতিনকে বেশিবারই প্রতিবাদ জানাতে হয়েছিল। কিন্তু, নিজে ফাউল না–করেও লাল কার্ড? ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ মানে তা–ই, বিশেষত দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলার হলে! ম্যাচ শেষে ইংল্যান্ডের কোচ অ্যালফ র‌্যামসের আর এক নাটক, আর্জেন্তিনার কোনও ফুটবলারের সঙ্গে দলের কাউকে জার্সি বদলাতে না–দেওয়ার। নিজেদের দেশে খেলা হলে প্রচারমাধ্যমের যে–যে সুবিধেগুলো পাওয়া যায়, সব দিক দিয়েই সেগুলো নিতে কোনও কার্পণ্য করেননি র‌্যামসে। এবং, ইংরেজ প্রচারমাধ্যম এখনও ওগুলো ছেপে চলেছে নিয়ম করেই!

    কোয়ার্টার ফাইনালে তার পরের ম্যাচে ইংল্যান্ডের রেফারি জিম ফিনি কৃতজ্ঞতা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সুদে–আসলে। জার্মানদের খেলা ছিল উরুগুয়ের বিরুদ্ধে। জার্মানরা ট্যাকল করে ফাটিয়ে দিচ্ছিলেন, রেফারির নির্দেশ বারবার, খেলা চালিয়ে যাও। আর উরুগুয়ের ফুটবলাররা, মারতে যাঁদের দক্ষতাও খুব কম নয়, ট্যাকল করলেই জার্মানরা হাত–পা ছড়িয়ে গলা ফুলিয়ে এমনভাবে মাটিতে পড়ছিলেন যে, দর্শকরা গ্যালারি থেকেও সেই আর্ত চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলেন, ‘ওরে বাবা রে, মেরে ফেলল রে!’ ফাউল, কার্ড বেরতে দেরি হয়নি একবারও। ত্রোস, সিলভা — দুজনকে বের করে দিয়ে ইংরেজ রেফারি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছিলেন জার্মানির কাছে। ৪–০ জয়ী পশ্চিম জার্মানি তারপর, বেকেনবাওয়ারকে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি উরুগুয়ের মাঠে–থাকা ৯ জনের পক্ষে। অভিশাপ দিতে দিতে মাঠ ছেড়েছিলেন উরুগুয়ের ফুটবলাররা।

    পর্তুগালের বিরুদ্ধে ইতিহাস রচিত হচ্ছিল গুডিসন পার্কে। খেলার প্রথম মিনিটের আগেই ০–১ পিছিয়ে ইউসেবিওরা। পার্ক সিউং জিন–এর গোল ৫৫ সেকেন্ডে। সেখানেই শেষ নয়। ২০ মিনিটে লি দং উন, ২৪ মিনিটে ইয়াং সাং কুক উত্তর কোরিয়াকে এগিয়ে দিলেন ৩–০! প্রথম খেলতে এসেই সেমিফাইনাল, কোরীয়রা আর ভাবতে পারছিল না তার পরের কথা।



    যাঁরা পারেন, এমন পরিস্থিতিতেও পারেন। সেজন্যই তাঁদের জায়গা হয় লোকগাথায়। ইউসেবিও ২৬ মিনিটে প্রথম গোল শোধ করে জাল থেকে বল নিয়ে ছুটলেন সেন্টার সার্কেলের দিকে। বিরতির বাঁশি বাজার ঠিক আগে তোরেসকে বক্সে আটকানো হল, পেনাল্টি, ইউসেবিওর শটে ২–৩। বিরতির পর এবার আবার ইউসেবিওকেই আটকাতে গিয়ে পেনাল্টি, ৩–৩। তারপর, প্রথম গোলের মতোই চতুর্থ গোল, দৌড়তে দৌড়তে জোরালো শট। পঞ্চম গোল তৈরি করে দিলেন কর্নার থেকে, হেডে তোরেসের পাস থেকে অগুস্তোর গোল, ৫–৩! ইউসেবিওর ম্যাচ বললে কম বলা হবে, বিশ্বকাপের ইতিহাস এমন ফিরে আসা দেখেনি।

    কোরীয়দের অনভিজ্ঞতা, ৩–০ এগিয়ে যাওয়ার পরও আরও গোলের জন্য যাওয়া, যখন উচিত ছিল ব্যবধান ধরে রাখতে রক্ষণাত্মক খেলা, ইউরোপের বিশেষজ্ঞরা এমন অনেক কারণ খুঁজে বের করেছেন। কিন্তু, তিন গোলে পিছিয়ে যাওয়ার পর কোনও মানুষ যে এমন ফুটবল খেলতে পারেন, এই সহজ সত্য ভুলে যাবেন কী করে! মোজাম্বিকে জন্ম, পর্তুগিজ অ্যাডভেঞ্চার–প্রিয়তায় বেড়ে ওঠা যাঁর, তিন গোল খেয়ে পাঁচ গোল দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন যিনি, ইউসেবিওকে পর্তুগিজরা তো আর এমনি এমনি রাজার আসনে বসায়নি! যখন দেশের হয়ে গোলসংখ্যায় ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো পেরিয়ে যান ইউসেবিওকে এবং এখনকার প্রচারমাধ্যম বন্দনায় মেতে ওঠে ক্রিস্তিয়ানোর, প্রথম প্রতিবাদ এসেছিল লুইস ফিগোর কাছ থেকে। অকিঞ্চিৎকর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রচুর গোল করে ইউসেবিওকে পেরিয়ে যাওয়া একেবারেই মানতে পারেননি ফিগো। পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, ইউসেবিওর সঙ্গে একই সারিতে থাকার যোগ্যই নন ক্রিস্তিয়ানো। আর ইউসেবিও? হেসে হেসেই বলেছিলেন, ‘গোটা ষাটেক ম্যাচ খেলেছিলাম ৪১ গোল করতে। এখন হঠাৎ শুনছি শ’খানেক ম্যাচ খেলে সেই রেকর্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া, লিচেনস্টেইন বা আজারবাইজান–টাইজানের বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ তো আর আমাদের আমলে ছিল না!’

    হাঙ্গেরিকে হারিয়ে রাশিয়া অন্য সেমিফাইনালে পশ্চিম জার্মানির সামনে।

    সেমিফাইনাল

    ২–১ জিতেছিল রাশিয়া, সেমিফাইনালে হারও ওই এক ব্যবধানে। প্রথম গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়ার পর রুশ চিসলেঙ্কো সেন্টারের পরই বলের দখল হারিয়ে হেল্ডকে পেছন থেকে গোড়ালিতে মারেন। প্রতিযোগিতার হিসেবে কোনও ফাউলই নয়, ইতালির রেফারি লো বেলো লাল কার্ড দেখিয়ে দিলেন। দ্বিতীয়ার্ধে রুশ দল দশজনেই খেলল। বেকেনবাওয়ারের গোলের সময় লেভ ইয়াসিন নড়েননি। দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন? হয় দেখতে পাননি অথবা বুঝতে ভুল করেছিলেন। ৮৭ মিনিটে পরকুজান একটি গোল শোধ দিলেও দেরি হয়ে গিয়েছিল। জার্মানরা আবার ফাইনালে।

    ববি চার্লটনের দুগোল প্রথমবার ফাইনালে তুলল ইংল্যান্ডকেও। নবি স্টাইলসের দায়িত্বে ছিলেন ইউসেবিও। নিজের ফর্মের ধারে কাছে যেতে পারেননি। ইংরেজরা তো জানতই, কোনও সমস্যা হবে না পর্তুগাল। পেলেকে মেরে বের করে দিয়েছিলেন বলে মোরেসকে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যারা খেলায়নি, ববি মুর তাদের জন্যই বলে দিয়ে ছিলেন, ‘ভাল খেলা হবে, জিতব আমরা।’ উত্তর ইউরোপে ওসব চলে না। জিততে হবে, সেজন্য দরকারে মারতে হলে মারতেই হবে। প্রো সাকসেস মোটিফ, জেতার জন্য সব, খেলার জন্য কিচ্ছু নয়। ইংল্যান্ড বা জার্মানি হলে মোরেসকে মাথায় তুলে রাখা হত, পেলের দোষ খুঁজে বের করে। পর্তুগাল ইউরোপেরই দেশ, কিন্তু, দক্ষিণ ইউরোপের। ব্রাজিলে উপনিবেশ ছিল, ফুটবল ব্রাজিলকে ঠিকঠাক শিখিয়েছিল পর্তুগিজরাই। আর উত্তর ও দক্ষিণ ইউরোপের ফুটবলের ফারাক মহাদেশের দুই বিভিন্ন অংশের মানুষের মানসিকতার মতোই, আকাশ–পাতাল।

    ববি চার্লটনের দুগোলের পর, খেলার একেবারে শেষ দিকে তোরেসের হেড গোলে ঢোকার মুখে জ্যাক চার্লটন হাত দিয়ে আটকে ফেলেন। পেনাল্টি, ইউসেবিও মারবেন যথারীতি। ব্যাঙ্কসের মনে ছিল, আগের দুবারই ডানদিকে মেরেছেন ইউসেবিও। এবার দিক পাল্টাতেও পারে বলে সতীর্থরা উল্টো দিকই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, ব্যাঙ্কসের কেন যেন মনে হচ্ছিল ডান দিকেই আসবে, শেষ মুহূর্তে কোলুনা যখন ইউসেবিওর কানে কানে গিয়ে কিছু বলে এসেছিলেন, ব্যাঙ্কসও ধরে নিয়েছিলেন, দিক পাল্টাচ্ছেন ইউসেবিও, কিন্তু, ‘গোলের পর কাঁদতে ইচ্ছে করছিল’, লিখেছেন ব্যাঙ্কস। বাকি সময়ে কোলুনার দুর্দান্ত শট বাঁচিয়ে যিনি ইংরেজদের পার্টি নষ্ট হতে দেননি, উঠে এসেছিলেন ইয়াসিনের পথ ধরে, বিশ্বসেরা গোলরক্ষক হিসেবে।

    তবে, আসল নাটক ছিল সেমিফাইনালের আগে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পর্তুগাল হওয়ার কথা ছিল গুডিসন পার্কে। এভারটনের মাঠে। । দুর্দান্ত ছন্দে ইউসেবিও। উত্তর কোরিয়ার ম্যাচ মনে করুন।

    বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের ঠিক আগে সিদ্ধান্ত হল, গুডিসন পার্কে নয়, সেমিফাইনাল হবে ওয়েম্বলিতেই। সরকারি কারণ, দর্শকসংখ্যা অনেক বেশি। বেসরকারি কারণ? পর্তুগালের প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত! আরে বাবা, ফিফা সভাপতির নাম যে স্ট্যানলি রাউস!

    লিভারপুল থেকে লন্ডন, বাসে পাঁচ-ছ’‌ঘণ্টা গিয়ে খেলতে নামতে হয়েছিল পর্তুগালকে, বিনা প্রস্তুতিতে। ইউসেবিও পরে বলেছিলেন, আমরা যেহেতু মেনেই নিয়েছিলাম, প্রতিবাদ করার কোনও মানে হয় না। কিন্তু ওই উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আসল সত্য, ঠিক কতটা অসুবিধায় পড়েছিলেন পর্তুগিজ ফুটবলাররা। ইংরেজদের একবার যদি আগের তৈরি সূচির বাইরে হঠাৎ করে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল অন্য মাঠে খেলতে হয় এবং সে জন্য বাসে করে যেতে হয় পাঁচ–‌ছ’‌ঘন্টা, কী কী বলতে এবং লিখতে পারে ইরেজ প্রচারমাধ্যম, একবার ভেবে দেখতে পারেন!‌

    ফাইনাল

    স্যার অ্যালফ র‌্যামসে। ইংল্যান্ডের কোচ হিসেবে উইন্টারবটমের পর যাঁকে কোচ হিসেবে কেউ কোনও নম্বর দিতে চাননি। অথচ বাকি কোচরা কেউ প্রথম বিভাগে নিয়ে আসতেও পারেননি ইপসউইচ টাউনের মতো ছোট দলকে। স্পেনের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের আগে র‌্যামসে দুই উইঙ্গারের ওপর বিরক্ত হয়ে কাউকে নামাননি। ‘উইংলেস ওয়ান্ডার’ নাম হয়ে গিয়েছিল, পরবর্তীতে যে ছক ৪–৪–২ হয়ে যায়। জিওফ হার্স্টকে দলে নেওয়া নিয়েও কম কথা প্রথমে শুনতে হয়নি। গ্রিভস আহত হওয়ার পর হার্স্ট সেই যে দলে এলেন, র‌্যামসেও কখনও গ্রিভসকে আর ফেরানোর কথা ভাবেননি।

    কিন্তু, জার্মানির সমস্যা হয়ে দাঁড়ান ববি চার্লটন। সেমিফাইনালে তাঁর পারফরম্যান্সের পর জার্মান কোচের সামনে চার্লটনকে মার্ক করানো ছাড়া উপায় ছিল না। কে নেবেন সেই ভার? বেকেনবাওয়ার ছাড়া আর কেউ ছিলেন না দলে যাঁর ওপর এত বড় কাজের দায়িত্ব দিতে পারতেন হেলমুট শোন। ফলে, বেকেনবাওয়ার দায়িত্ব নিলেন, চার্লটনকে খেলতে দিলেন না যথারীতি। কিন্তু, চার্লটনের যাত্রাভঙ্গ করতে গিয়ে নিজের নাক কেটে ফেলল জার্মানি, বেকেনবাওয়ারকে বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো খেলায় নষ্ট করলেন শোন!

    হ্যালারের প্রথম গোলের সময় ইংল্যান্ড রক্ষণ বেসামাল, পারস্পরিক কোনও যোগাযোগ ছিল বলেই মনে হয়নি। ব্যাঙ্কস আর জ্যাকি চার্লটন দুজনেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলের গোলে যাওয়া দেখতে দেখতে ভাবছিলেন, ‘ও ধরবে’! কিন্তু, প্রথম গোল খাওয়া ইংরেজদের মনে পড়িয়ে দেয় এক অদ্ভুত সংস্কারের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তখনও পর্যন্ত সব বিশ্বকাপের ফাইনালে প্রথমে গোল করা দল হেরেছিল। ইংল্যান্ড ভাবতে শুরু করে তারাও জিতবে। এবং জেতেও, সে যত বড় বিতর্কই হোক না কেন!

    ববি মুর এগোতে শুরু করলেন গোল খেয়ে, ফাউল করে আটকানো হল, মাঝে থিয়েরি অঁরি যা প্রায়ই করতেন, রেফারির বাঁশি বাজার আগেই মুরের ফ্রি–কিক আকাশে, ঠিক ডিফেন্ডারদের নাগাল এড়িয়ে হার্স্টের মাথায়, ১–১। এরপর খেলা সীমাবদ্ধ দুদলের ডিফেন্সিভ থার্ডে। জমাট রক্ষণ, ভেদ করে কোনও দলই কিছু করতে পারছিল না। খেলার শেষ দিকে অ্যালান বলের কর্নারে হার্স্টের শট জার্মান ডিফেন্ডার হটজেস আকাশে তুলেছিলেন, পিটার্স সুযোগ হারাননি। আর তো ১২ মিনিট, ইংরেজরা নেমে এল রক্ষণে। কিন্তু আটকানো গেল না। ওয়েবার সমতা ফেরালেন এমেরিচের ফ্রি–কিক থেকে। ১৯৩৪ সালের পর প্রথম বার বিশ্বকাপ ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ের খেলা।

    র‌্যামসের সেই লাইন, ‘একবার জিতে গেছ বিশ্বকাপ ফাইনাল, আর একবার জিতে দেখাও’ তারপর। অ্যালান বল দৌড়লেন আরও একবার, ডান দিকের কর্নার ফ্ল্যাগের সামনে থেকে ক্রস রাখলেন হার্স্টের জন্য। শ্যুলজের ভুল, হার্স্টের শট বারে লেগে মাটিতে পড়ল, ওয়েবার হেড দিয়ে বের করে দেখলেন রেফারির মনে হয়েছে গোল! ইংরেজদের আনন্দের পাশাপাশি জার্মানদের প্রতিবাদ চলল। সুইস রেফারি গটফ্রায়েড ডিয়েনস্ট দৌড়লেন লাইনসম্যান আজারবাইজানের টোফিক বাখরামভের দিকে। অনেক দূরে থাকা সত্ত্বেও টোফিকের সিদ্ধান্ত, গোল। জার্মানরা এমন অন্যায়ের সামনে ভেঙে পড়ল এবার।

    বিতর্ক চলছে আজও। ছবি থেকে পরিষ্কার, বল যখন তার ছায়াকে সত্যি সত্যিই ধরবে, গোললাইন পেরনোর কোনও প্রশ্ন থাকতেই পারে না। অর্থাৎ, বিতর্কের কোনও জায়গা নেই, গোল নয়। কিন্তু, ওই গোলই দিয়ে গেল ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ। হতভাগ্য জার্মানরা চেষ্টা করেও মন দিয়ে খেলতে পারেননি আর, শরীরের ভাষায় হাল ছেড়ে দেওয়ার ভাবনা পরিষ্কার, হার্স্ট আবার তারই মধ্যে মুরের লম্বা পাশ ধরে হ্যাটট্রিক করে যান বিশ্বকাপ ফাইনালে। এখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপ ফাইনালে একমাত্র হ্যাটট্রিক। কিন্তু, বিতর্কের দাগ মোছেনি আজও।

    1 comment:

    1. L'Islam n'est ni une secte, ni une religion ethnique. http://www.twistertrucks.com/__media__/js/netsoltrademark.php?d=www.m-islam.fr%2Fl-imam-mahdi-samir-abdellah-le-banifer-vs-iblis-devoiler-par-allah-partie-2%2F

      ReplyDelete